চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভা ৩০ ডিসেম্বর, নির্বাচন ৩১ ডিসেম্বর
1 December 2012
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত
30 December 2012
দেখুন সব খবর

চট্টগ্রামের সংবাদপত্র : সমকালের চ্যালেঞ্জ

iconarticle১.
এ নিবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় চট্টগ্রামের সমকালীন সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ। ফলে এর সাথে সমকালীন প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো আলোচনায় আসবে।
পাকিস্তানি আমল থেকে প্রকাশনার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরে চট্টগ্রামে যে-কটি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছিল তার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং প্রকাশনা ও প্রচারের দিক থেকে সর্বাগ্রে বলতে হয় দৈনিক আজাদীর কথা। একই বিবেচনায় এরপর নাম করতে হয় ইংরেজি দৈনিক পিপলস ভিউ-র। এ দুটি বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকার পূর্বসুরী সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম-এর দৈনিক জমানা এবং ১৯৬৫-র কায়রো দুর্ঘটনায় নিহত এসএম মোবিন সাহেবের দ্য ইউনিটি বা আলী খানের ইস্টার্ণ এগজামিনার ভিন্ন ভিন্ন কারণে এই পালাবদলের নতুন চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে পারে নি। তবে দৈনিক জমানা এর সম্পাদকের সাহিত্যকৃতির মতই পাঠকের রুচি ও চাহিদা অনেকখানি মিটিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বহুকাল পরেও আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। দৈনিক আজান তার পৃষ্ঠপোষকের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে সঙ্গতভাবেই বাঙালির একাত্তরের উত্তরণের সাথে পাল্লা দিতে পারে নি।
স্বাধীনতা, আগেই বলেছি, খুলে দিয়েছিল এক নতুন দিগন্ত। এ সময় দেশ সেবার, মানুষের জন্যে কিছু করার ঐকান্তিক আগ্রহ যেমন তীব্র হয়ে উঠেছিল তেমনি যুগের ও নতুন সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সৃষ্ট সুযোগ কাজে লাগানোর জন্যেও অনেক তরুণ দারুণভাবে মুখিয়ে উঠেছিল। স্বভাবতই উৎসাহে-অতিউৎসাহে ভর করে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করার জন্যে অনেকেই এগিয়ে আসবে।
প্রথমেই মনে পড়ছে দৈনিক স্বাধীনতার কথা। এর উদ্যোক্তা ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রগতিপন্থী নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী। তিনি ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত প্রথম কবিতা মাহবুবউল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’- এর রচনা ও প্রকাশনার সাথেও যুক্ত ছিলেন। পত্রিকার নামকরণ এবং মাহববউল আলম চৌধুরীকে সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দানের এবং গুরুত্বপূর্ণ সব পদে ষাটের দশকের পরিচিত প্রগতিশীল তরুণদের নির্বাচনের মধ্যে উদ্যোক্তার সদিচ্ছার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে তখনকার অস্থির ও অস্থিতিশীল অবস্থায় উপযুক্ত সাংগঠনিক ও পেশাদারী অঙ্গীকারের ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ায় যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ পত্রিকাটি খুব বেশি দূর এগোতে পারে নি। পরেও বিভিন্ন সময়ে পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ গৃহীত হলেও কখনও এর যাত্রা সুগম হয় নি।
এ সময়ে সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে উৎসাহী তরুণরা প্রকাশ করেছিল অমর বাংলা। পার্থপ্রতিম বড়–য়া ছিলেন এর প্রকাশক ও সম্পাদক। এটি কর্মীদের সৃজনশীলতার পুঁজির ওপর যতটা নির্ভর করেছে আনুপাতিকভাবে সাংগঠনিক দিক ততটা গুছিয়ে তুলতে পারে নি। জনাব এম.এ. কুদ্দুসের দৈনিক মিছিল ছোট আঙ্গিকে সংবাদপত্রের দাবি পূরণ করে আসছিল। তবে তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে সমাজতন্ত্রের ভাবাবেগ ছড়িয়ে যে জাসদপন্থী বিপ্লবী রাজনীতির উদ্গম হচ্ছিল তার অঙ্গীকার ও উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রকাশিত ‘দেশবাংলা’ কিছুকালের জন্যে বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছিল। তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রান্তি, ব্যর্থতা, গা-জোয়ারি মনোভাবের বিরুদ্ধে শিক্ষিত শহুরে মানুষের মনোভাব বেশ বিরূপ হয়ে উঠছিল, আর তাতে সমালোচনামুখর আক্রমণাত্মক সাংবাদিকতার মাধ্যমে এ পত্রিকা বেশ পাঠক টেনেছিল। এক সময় পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, কয়েকজন সাংবাদিক কারাবরণও করেছিলেন। যাহোক, শেষ পর্যন্ত জাসদের রাজনীতির মতই এটিও আকস্মিকভাবে হারিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের তরুণ-তুর্কি মহিউদ্দিন চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় আর লেখক হেনা ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক আন্দোলন প্রাথমিক যে আশা জাগিয়েছিল শেষ পর্যন্ত তার প্রতি সুবিচার করতে পারে নি। আওয়ামী-বিরোধিতার রাজনীতি যখন তুঙ্গে তখন সবচেয়ে হৈচৈ ফেলেছিল মওলানা ভাসানীর যে হক-কথা তারও প্রকাশক ছিলেন চট্টগ্রামের শাখাওয়াত হোসেন, যিনি এর আগে কিছুদিন প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবার্তা নামে একটি সাপ্তাহিক। এ গুলোর পর আবদুল্লাহ আল সগীর প্রকাশ করেন দৈনিক নয়াবাংলা। মুসলিম লীগের সাথে তাঁর যোগ থাকলেও তিনি পত্রিকাটি সময়োপযোগী ও টেকসই করার চেষ্টা করেছিলেন। অনেক বাধাবিঘœ পেরিয়ে পত্রিকাটি তাঁর মৃত্যুর পরেও কিছুদিন টিকেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
স্বাধীনতার পরপর এই যেসব সংবাদপত্র চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলোর ভূমিকা কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে কিনা সেটা রীতিমত গবেষণার বিষয়, তবে আয়ুর বিচারে কোনোটিই কালোত্তীর্ণ হয় নি।
কিন্তু স্বল্পায়ু এই পত্রিকাগুলো চট্টগ্রামে একসাথে একঝাঁক তরুণকে অকস্মাৎ সংবাদপত্রের জগতে ঠাঁই দিয়েছে, সাংবাদিকের পরিচয় দিয়েছে এবং তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ও দৈন্য সত্ত্বেও এ পেশার মহত্ত্ব ও মজা উভয়ের স্বাদই দিয়েছে। একাত্তরের আগে চট্টগ্রামে প্রকৃত সাংবাদিকের সংখ্যা পঞ্চাশও হবে না। কিন্তু স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যে সে সংখ্যা নিঃসন্দেহে একশ ছাড়িয়ে যায়। এই এলোমেলো, কিছুটা সৌখিন কিছুটা পেশাদারী উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে শত বাধাবিঘেœর মধ্যেও সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সম্ভাবনা ও ইচ্ছার যুগলপ্রকাশ ঘটেছিল।
পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম শহরে গণতান্ত্রিক বাতাবরণ সৃষ্টি, সুশীলসমাজে প্রগতি ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান সংহত করা এবং জাতীয় পর্যায়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামকে তীক্ষèতা দানের ক্ষেত্রে দেখা যাবে এই নবীন সাংবাদিক সম্প্রদায়, তাদের পেশাগত অনিশ্চয়তা ও দৈন্যের মধ্যেও, বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে।

২.
বস্তুত ১৯৭৫ সনে বাকশাল গঠনের পর সংবাদপত্র সংকোচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এরশাদ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেছে তার আগেও, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তার খেতাবপ্রাপ্ত জেনারেল জিয়ার শাসনামলে, কার্যত দেশে এক ব্যক্তির কর্তৃত্ববাদী শাসন চলেছিল। আর জিয়া ও এরশাদ এই দুই সামরিক শাসকের ক্ষমতারোহণ, ক্ষমতা সংহতকরণ এবং ক্ষমতা ভোগ সবই জবরদস্তিমূলক ছিল বলে স্বভাবতই তখন সংবাদপত্রের খুবই করুণ সময়। অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকে পেশা ত্যাগ করেছেন, সবচেয়ে বড় কথা তারুণ্যের যে উদ্দীপনা এবং স্বাধীনতার চেতনায় সৃষ্ট যে দায়িত্ববোধ মিলিয়ে সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশ ও মানুষের জন্যে কাজ করার স্পৃহা সৃষ্টি হয়েছিল তাতে এ সময়ে ভাঁটার টান লেগেছে। দু’দুটি সামরিক জবরদস্তিমূলক কর্তৃত্ববাদী শাসনের নিচে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন ছিল না তেমনি যে পেশা অন্তর্নিহিতভাবে স্বাধীন তা সার্থকভাবে পালন করা হয়ে পড়ে অসম্ভব।
এরই পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতে আর অর্থনীতিতেও পরিবর্তনের হাওয়া উঠেছিল। মধ্য আশি থেকে ধীরে ধীরে সামনে আসছিল অর্থনীতির নতুন সব এজে-াÑ বেসরকারি উদ্যোগ, বিশ্বায়ন, বাজার অর্থনীতির ধারণাগুলো; ভোগ্যপণ্যের বিস্তার আমাদের দেশেও অনুভূত হতে থাকে। সাধারণ মানুষের উপার্জনের উদ্দেশ্যে ব্যাপকহারে বিদেশে যাওয়া একদিকে আর অন্যদিকে গার্মেন্টসের মাধ্যমে মেয়েদের বাড়ির বাইরে আসা ও উপার্জন করাÑ এসব মিলে সমাজে পরিবর্তনের ফ-ুধারা বইতে থাকে। সংবাদপত্র প্রকাশ এক সময় ব্যক্তির আদর্শবাদী আকাক্সক্ষা, দায়িত্ববোধ, একটা মানবিক ব্রত বা তার প্রকাশমাত্র ছিল। এর ব্যবসাবাণিজ্যের দিক নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাতেন না। কেউই শিল্প বা ব্যবসা হিসেবে সংবাদপত্রে অর্থলগ্নি করতে আসেন নি। বরং অন্যান্য ক্ষেত্রে অর্থ উপার্জন করে বাড়তি অলস অর্থসম্পদের মালিক হয়ে সমাজের কাজ হিসেবে সংবাদপত্রের কথা মানুষ ভেবেছে। আমি নিশ্চিত চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন যে পত্রিকাটি আর্থিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত সেই দৈনিক আজাদীরও প্রতিষ্ঠাতা নিশ্চয় তাঁর প্রেস, লাইব্রেরি ও অন্যান্য ব্যবসার উপার্জন থেকে সখ করে বা মানুষের সেবার জন্যে প্রথমে পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে ১৯৮৬ সনে যখন দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তখন এর প্রকাশক ও উদ্যোক্তা জানিয়েছিলেন পত্রিকা থেকে কোনো মুনাফা গ্রহণের ইচ্ছে তাঁর নেই। এর যাবতীয় উপার্জন তিনি পত্রিকারই উন্নয়ন এবং চট্টগ্রামে প্রকাশনা শিল্পের উন্নয়নে ব্যয় করবেন।
কিন্তু ততদিনে সংবাদপত্র সত্যি সত্যি শিল্প হয়ে উঠেছে, সংবাদপত্রের বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে, পুরোনো বাজারে ভাগ বসানো এবং নতুন বাজার তৈরির মত সুযোগও এসে পড়েছে। মোটকথা বিনিয়োগ ও বিপণন নিয়ে ভাবনা ও পরিকল্পনার যুগ এসে গেছে, প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বিকাশের প্রশ্নটা প্রধান হয়ে উঠেছে। পূর্বকোণ, বলা যায়, ই-াস্ট্রি বা শিল্প হিসেবে চট্টগ্রামের প্রথম সংবাদপত্র।
সাংবাদিক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এ পত্রিকা নতুন প্রজšে§র জন্যে পথ খুলে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একঝাঁক উদ্যোগী সৃজনশীল তরুণ পূর্বকোণে তাদের পেশাজীবন শুরু করে চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার জগতে নতুন রক্তের প্রবাহ সঞ্চারিত করেছে। সৌখিন পেশা বা খেয়ালি মানুষের পেশার পরিবর্তে একটি আধুনিক যুগোপযোগী পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা গণ্য হতে শুরু করল এবার।
ক্রমে আজাদী ও পূর্বকোণ দুটি প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া হাউজ হিসেবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। নয়াবাংলা দীর্ঘদিন টানাপোড়েনের পরও মালিকানা পরিবর্তন করেও শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি। দৈনিক ঈশান কিছু সংবাদপত্রসেবীর দুর্ভোগের কারণ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে ইংরেজি দৈনিকের দিন যেন ফুরিয়ে এল। ইস্টার্ন এগজামিনার, দ্য ইউনিটি, দ্য পিপলস ভিউর দীর্ঘ গৌরবময় ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও এবং ১৯৭৮ সনে দ্য ডেইলি লাইফ অত্যন্ত সম্ভাবনা নিয়ে প্রকাশিত হলেও ধীরে ধীরে এ পত্রিকাগুলো পাঠক হারিয়েছে। ডেইলি লাইফ কেবল নাম রক্ষার জন্যে কিছুকাল প্রকাশিত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে। আর অতি সাম্প্রতিককালে দ্য পিপলস ভিউ মালিকানা পরিবর্তন করে ওসমান গণি মনসুরের নেতৃত্বে কিছুকাল প্রকাশিত হলেও শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কাগজের অবশ্য কোন প্রভাব ছিল না পাঠকের ওপর।
বাকি দুটি উল্লেখযোগ্য বাংলা পত্রিকার মধ্যে দৈনিক কর্ণফুলী মূলত জামায়াতে ইসলামীর দলীয় মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে এবং শিল্প হিসেবে টিকে থাকা ও বিকশিত হওয়ার সংকটেই ভুগছে। দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ একটি শিল্পগ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, সম্ভবত এ কারণেই নতুন এই পত্রিকা অত্যন্ত ধীরে হলেও সামনের দিকেই এগোচ্ছে। নতুন প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনা নিয়ে সর্বশেষ ২০০৪ সনে প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ। এ পত্রিকাটির মুদ্রণ ও অঙ্গসজ্জার মান বর্তমানে চট্টগ্রামের সব কাগজের চেয়ে ভালো। তবে ইদানিং শিল্প হিসেবে সংবাদপত্রে যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় তার অভাবে পত্রিকাটি তার প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। চট্টগ্রামের নিজস্ব আধুনিক পত্রিকার যে চাহিদা আছে তা পূরণের জন্যে অনেকেই এ পত্রিকার দিকে তাকিয়ে থাকেন। শীঘ্রই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে আরেকটি বাংলা দৈনিকÑদৈনিক পূর্বদেশ। এর সম্পাদক ওসমান গণি মনসুর ও উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে যোগ দিচ্ছেন দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক কামাল লোহানী।
যেসব পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে এবং যেসব পত্রিকা ঝিমিয়ে পড়েছে তার পিছনে প্রধান কারণ হচ্ছে এসব পত্রিকার উদ্যোক্তাগণ যুগের দাবি উপলব্ধি করতে পারেন নি। পত্রিকা যে আজ একটি আধুনিক বৃহৎ শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে সেদিকটা লক্ষ্য না রেখে পত্রিকা প্রকাশ করে মার খাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি এখন।
চট্টগ্রাম থেকে পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে নতুন একটি বাস্তবতারও উদ্ভব হয়েছে। মধ্য নব্বইতে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে দাউদকান্দি সেতু চালু হওয়ার পর বড় রকমের এই পরিবর্তন ঘটেছে। ফেরিবিহীন সরাসরি সড়কপথে ভোররাতের দিকে ঢাকা-চট্টগ্রামের পথ পাড়ি দিতে সময় লাগছে চার ঘণ্টার মত। সকালে দ্রুত পত্রিকা চট্টগ্রামে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ থাকায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিকগুলো চট্টগ্রামে প্রচার সংখ্যা বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছিল। এতে অনেকগুলো পত্রিকা ভালো ফল পেয়েছে। আর ইদানীং দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার এর চট্টগ্রাম সংস্করণ চট্টগ্রাম থেকেই মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর প্রচার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর দ্য ডেইলি স্টার বর্তমানে প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বীহীন অবস্থায় বাজারে রয়েছে। তবে ইংরেজি পত্রিকার পাঠক এখনও চট্টগ্রামে আশানুরূপ বাড়েনি।

৩.
অতীতের সাথে তুলনা করলে চট্টগ্রামে বর্তমানে পেশাদার সাংবাদিকের সংখ্যা অনেক বেশি। দেড়দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করছেন এমন সাংবদিকের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও লক্ষণীয় হল অতীতে যেভাবে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাহবুবউল আলম, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এসএম মোবিন, আতিকুল আলম, ফজলুর রহমান, মঈনুল আলম, সাইফুল আলম, হাবিবুর রহমান খান, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ প্রমুখ অনেকেই জাতীয়ভাবে স্বীকৃত ছিলেন, রাষ্ট্রীয়, সরকারি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে নিমন্ত্রিত হতেন ও স্বীকৃতি পেয়ে এসেছেন বর্তমানে তার অভাব দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তান আমলে বাজেট অধিবেশন, অর্থমন্ত্রীর বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন, কিংবা সরকার প্রধানের সম্পাদকদের সাথে বৈঠকে চট্টগ্রাম থেকে অনেক প্রবীণ সাংবাদিক-সম্পাদক আমন্ত্রিত হতেন। বর্তমানে এই রেওয়াজ একেবারেই উঠে গেছে।
বাংলাদেশ বড্ড বেশি ঢাকাঘেঁষা ও ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। আর তাতে উপেক্ষিত হচ্ছে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগ্য মেধাবী সাংবাদিকগণ। যথাযথ সম্মান-স্বীকৃতির অভাবেও একটি অঞ্চলে বিশেষ একটি ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি আসে না, বরং অবক্ষয় হতে থাকে। বাংলাদেশের ঢাকাকেন্দ্রিকতার ফলে চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিক সৃষ্টির সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে, আবার ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক পথ সংক্ষেপ এবং সড়ক যোগাযোগ দ্রুততর হয়ে আসায় ঢাকার পত্রিকার সাথে একটা অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে গেছে এখানকার সংবাদপত্র, শিল্প ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও আজ চট্টগ্রামে বসে জাতীয় পর্যায়ে কিছু করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
পত্রিকার আয়ের প্রধান উৎস যে বিজ্ঞাপন তার ক্ষেত্রে অনুসৃত সরকারি নীতিও আঞ্চলিক পত্রিকার প্রতি বিমাতাসুলভ। ফলে চট্টগ্রামের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার যে বিকাশ মধ্য আশি থেকে ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল তা দ্রুত একটি পর্যায়ে এসে থেমে পড়েছে। বর্তমানে নতুন পত্রিকা প্রকাশ বা নতুনভাবে এই পেশায় আসার সুযোগ অনেক সীমিত হয়ে পড়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি সরকারের ঘোষিত বেতন কাঠামো প্রবর্তনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পত্রিকাগুলো উদ্যোগী বা আগ্রহী নয়। তাদের রাজস্ব উৎস ও পত্রিকা বিক্রির বাজার সম্প্রসারণের সুযোগও খুবই সীমিত।
বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তিতে যে বিপ্লব ঘটেছে তাতে অবশ্য নতুনভাবে সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। এখন পৃথকভাবে চট্টগ্রাম বা অন্য কোন আঞ্চলিক পত্রিকার কথা ভাবার চেয়ে জাতীয় ভিত্তিক গণমাধ্যমের কথা ভাবার সময় এসেছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার আলাদাভাবে চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দিচ্ছে, মুদ্রণব্যবস্থা ছাড়াও অফিস, লোকবল এবং কাজের পরিধি অনেক বাড়িয়েছে। ডেইলি স্টার তো এ বছরের গোড়ার দিকে অদম্য চট্টগ্রাম নামে পক্ষকালব্যাপী এক উৎসবের আয়োজন করেছে যা এককথায় বিশালতায়, বৈচিত্রে ও গুরুত্বে অভূতপূর্ব স্মরণীয় অনুষ্ঠান হয়েছে। আজকের দিনে সংবাদপত্র জনমত তৈরি, জনসচেতনতা সৃষ্টি ও জনসেবার অনেক রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে। চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের এসব দিকে নজর দিতে হবে।
হতাশাজনক বিষয় হল, বৈদ্যুতিক গণমাধ্যমের বর্তমান প্রসারের সময়ে যখন নতুন নতুন চ্যানেল চালু হচ্ছে ও অনুমোদন নিচ্ছে তখন চট্টগ্রামের কোন উদ্যোক্তাই এক্ষেত্রে আগ্রহ দেখান নি। বরং যে একটি মাত্র চ্যানেল চট্টগ্রামী উদ্যোক্তার মালিকানায় ছিল সেটিও তাঁদের হাতে আর নেই।
চট্টগ্রাম অতীতে অনেক ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছে, অগ্রসেনার কাজ করেছে, সংবাদপত্রেও এরকম ভূমিকা ছিল। কিন্তু আজকের পরিবর্তিত সময়ের যে দাবি তাতে সাড়া দেওয়ার মত উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীর দেখা মিলছে না। বরং চট্টগ্রামের পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীদের বড় অংশ রাজধানীমুখী হয়ে পড়েছেন।
উপর্যুক্ত পর্যবেক্ষণের আলোকে বলা যায়, চট্টগ্রামের গণমাধ্যম জগৎ আমাদের অলক্ষ্যে একটি ক্রান্তিলগ্নে উপনীত হয়েছে। এই সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ সঠিকভাবে অনুধাবন করা না গেলে স্থবিরতা অবক্ষয়ের দিকেই গড়াবে। আর যদি সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় তবে চট্টগ্রাম থেকেই গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী নতুন ধারার সূচনা করা সম্ভব হবে। তার জন্যে প্রয়োজন হবে সাহসী উদ্যোক্তা এবং সৃজনশীল সংবাদকর্মীর সমন্বিত কার্যক্রম। স্থবিরতা কাটানো কিংবা ক্রান্তিকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহসী মৌলিক যুগান্তকারী পদক্ষেপেরই প্রয়োজন হয়।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক